ভোর হলো কবিতা সম্পূর্ণ
ভোর হলো কবিতা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বিদ্রোহী কবি হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। জন্ম ২৪ মে ১৮৯৯ (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতবর্ষের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রাম। পিতা কাজী ফকির আহমদ, মা জাহেদা খাতুন। ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল আশালতা সেনগুপ্তা (বিবাহোত্তর নাম প্রমীলা)-কে বিয়ে করেন। শিয়ারশোল রাজস্কুলে ১৯১৭ সালে প্রি-টেস্ট পরীক্ষাকালে পড়াশুনা ত্যাগ করে ৪৯ নং নম্বর বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য এবং হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন।
সরকারি-বেসরকারি নার্সিং ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ব্যাংক ২০২৩
১৯২৩ সালে হুগলি জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালীন সময়ে কয়েদিদের ওপর জেল কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এ বছরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক তাঁকে উৎসর্গ করেন। ১৯৩০ সালে তাঁর চার বছরের প্রিয় শিশুপুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে মারা গেলে শোকে মুহ্যমান হয়ে আত্মার প্রশান্তি লাভের জন্য বরদাকান্ত মজুমদারের কাছে অধ্যাত্ম-সাধনার দীক্ষা গ্রহণ করেন। ‘প্রলয় শিখা’ কাব্যগ্রন্থে রাজদ্রোহমূলক কবিতা থাকার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলা করা হয়। আদালত তাঁকে ছয় মাসের কারাদ- প্রদান করে। ১৯৩১ সালের ৪ মার্চ গান্ধী-আরউইন চুক্তির ফলে জেল খাটার দায় থেকে তিনি অব্যাহতি পান। ১৯৪২ সালের ১০ অক্টোবর মস্তিষ্কের ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। অতঃপর যোগসাধনায় মনোনিবেশ। কিছুকাল পরে চৈতন্য ও বাকশক্তি লোপ পাওয়ায় তাঁর সাহিত্য-সাধনার পরিসমাপ্তি ঘটে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থাতেই তিনি জীবনযাপন করেন। সম্পাদিত পত্রিকা : সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ (১৯২০)-এর যুগ্ম সম্পাদক; অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ (১৯২২), সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ (১৯২৫) এবং ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে নবপর্যায়ে ‘দৈনিক নবযুগ’ প্রকাশিত হলে এর সম্পাদক নিযুক্ত হন তিনি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : অগ্নিবীণা (১৯২২); বিষের বাঁশি (১৯২৪); ভাঙার গান (১৯২৪); সাম্যবাদী (১৯২৫); সর্বহারা (১৯২৬); ফণি-মনসা (১৯২৭); জিঞ্জির (১৯২৮); সন্ধ্যা (১৯২৯) ও প্রলয়-শিখা (১৯৩০)। যেসব কাব্যে কবির প্রেমিকরূপ প্রকাশিত : দোলন-চাঁপা (১৯২৩); ছায়ানট (১৯২৪); পুবের হাওয়া (১৯২৫); সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৭) ও চক্রবাক (১৯২৯)। জীবনীমূলক কাব্য : চিত্তনামা (১৯২৫) ও মরু-ভাস্কর (১৯৫৭)। শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ : ঝিঙেফুল (১৯২৬) ও সাতভাই চম্পা। উপন্যাস : বাঁধনহারা (১৯২৭); মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০) ও কুহেলিকা (১৯৩১)। গল্পগ্রন্থ : ব্যথার দান (১৯২২); রিক্তের বেদন (১৯২৫) ও শিউলিমালা (১৯৩১)। নাটক : ঝিলিমিলি (১৯৩০); আলেয়া (১৯৩১) ও মধুমালা (১৯৫৯)।
প্রবন্ধ : যুগবাণী (১৯২২); রাজবন্দীর জবানবন্দী (১৯২৩); দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬) ও রুদ্রমঙ্গল। সঙ্গীত গ্রন্থাবলী : বুলবুল (১ম খণ্ড ১৯২৮, ২য় খণ্ড ১৯৫২); চোখের চাতক (১৯২৯); চন্দ্রবিন্দু (২য় সংস্করণ ১৯৪৬); নজরুল-গীতিকা (১৯৩০); নজরুল স্বরলিপি (১৯৩১); সুরসাকী (১৯৩১); জুলফিকার (১৯৩২); বন-গীতি (১৯৩২); গুলবাগিচা (১৯৩৩); গীতি-শতদল (১৯৩৪) ও গানের মালা (১৯৩৪)। এ ছাড়া বাংলা একাডেমী থেকে ৪ খ-ে ‘নজরুল রচনাবলী’ (১৯৯৩) প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে তাঁকে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘জগত্তারিণী স্বর্ণ-পদক’ (১৯৪৫); ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৬০); রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডি-লিট’ (১৯৬৯); ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডি-লিট’ (১৯৭৪) এবং বাংলাদেশ সরকার ‘একুশের পদক’ (১৯৭৬) প্রদান করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের বিশেষ আগ্রহে ১৯৭২ সালের ২৪ মে তাঁকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে কলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং পরবর্তী সময়ে তাঁকে বাংলাদেশের সম্মানিত নাগরিকত্ব করে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে) ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রভাতী
কাজী নজরুল ইসলাম
ভোর হলো দোর খোলো
খুকুমণি ওঠো রে!
ঐ ডাকে যুঁইশাখে
ফুল-খুকি ছোট রে!
খুকুমণি ওঠো রে!
রবি মামা দেয় হামা
গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান গায় গান
শোনো ঐ, ‘রামা হৈ!’
ত্যজি নীড় করে ভিড়
ওড়ে পাখি আকাশে,
এন্তার গান তারা
ভাসে ভোর বাতাসে।
চুলবুল বুলবুল
শিস দেয় পুষ্পে,
এইবার এইবার
খুকুমণি উঠবে!
খুলি হাল তুলি পাল
ঐ তরী চললো,
এইবার এইবার
খুকু চোখ খুললো।
আলসে নয় সে
ওঠে রোজ সকালে,
রোজ তাই চাঁদা ভাই
টিপ দেয় কপালে।
উঠলো ছুটলো
ওই খোকা খুকি সব,
‘উঠেছে আগে কে’
ঐ শোনো কলরব।
নাই রাত, মুখ হাত ধোও,
খুকু জাগো রে!
জয় গানে ভগবানে
তুষি’ বর মাগো রে!
আরিয়ান নামের অর্থ
খোকার সাধ
–আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসম-বাগে উঠবো আমি ডাকি।
সূয্যি মামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’–মা বলবেন রেগে।
বলবো আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাকো,
হয়নি সকাল–তাই বলে কি সকাল হবে নাকো!
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’
ঊষা দিদির ওঠার আগে উঠবো পাহাড়-চূড়ে,
দেখবো নিচে ঘুমায় শহর শীতের কাঁথা মুড়ে,
ঘুমায় সাগর বালুচরে নদীর মোহনায়,
বলবো আমি, ‘ভোর হলো যে, সাগর ছুটে আয়!’
ঝর্ণা-মাসি বলবে হাসি, ‘খোকন এলি নাকি?’
বলবো আমি, ‘নইকো খোকন, ঘুম-জাগানো পাখি!’
ফুলের বনে ফুল ফোটাবো, অন্ধকারে আলো,
সূয্যিমামা বলবে উঠে, ‘খোকন, ছিলে ভালো?’
বলবো, ‘মামা, কথা কওয়ার নাইকো সময় আর,
তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙো ঘুমের দ্বার।’
রবির আগে চলবো আমি ঘুম-ভাঙা গান গেয়ে,
জাগবে সাগর, পাহাড় নদী, ঘুমের ছেলে-মেয়ে!
সংকল্প
থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে
মরছে যে বীর লাখে লাখে।
কিসের আশায় করছে তারা
বরণ মরণ যন্ত্রণাকে,
কেমন করে বীর ডুবুরি
সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
কেমন করে দুঃসাহসী
চলছে উড়ে স্বর্গপানে।
হাউই চড়ে যায় যেতে কে
চন্দ্রলোকের অচিনপুরে,
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোনো
মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।
পাতাল ফেড়ে নামবো আমি
উঠবো আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্বজগৎ দেখবো আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
খুকি ও কাঠবেড়ালি
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্ছা? কুকুর-ছানা? তাও–
ডাউনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল?
দেখবি তবে? রাঙাদা-কে ডাকবো? দেবে ঢিল!
পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!
তাই তো তোর নাকটি বোঁচা!
হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস
একলাই খাও হাপুস হুপুস!
পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি–কুষ্টি মুখে!
হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
ইস্! খেয়ো না মস্তপানা ঐ যে পাকাটাও!
আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!
ব্যাডমিন্টন খেলার নিয়ম
কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি হবে? বৌদি হবে? হুঁ!
রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঃ!
এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?
ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?
আর খেয়ো না পেয়ারা তবে,
বাতাবি-নেবুও ছাড়তে হবে!
দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছো যে ছুট? অ-মা দেখে যাও!
কাঠবেড়ালি! তুমি মরো! তুমি কচু খাও!!
লিচু চোর
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাঁড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা, মড়াৎ করে
পড়েছি সড়াৎ জোরে!
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুসি
একদম জোরসে ঠুসি!
আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল!
আরে ধ্যাৎ শেয়াল কোথা?
ভোলাটা দাঁড়িয়ে হোথা!
দেখে যেই আঁতকে ওঠা
কুকুরও জুড়লে ছোটা!
আমি কই কম্ম কাবার
কুকুরেই করবে সাবাড়!
‘বাবা গো মা গো’ বলে
পাঁচিলের ফোঁকল গলে
ঢুকি গ্যে বোসদের ঘরে,
যেন প্রাণ আসলো ধরে!
যাবো ফের? কান মলি ভাই,
চুরিতে আর যদি যাই!
তবে মোর নামই মিছা!
কুকুরের চামড়া খিঁচা
সে কি ভাই যায় রে ভুলা–
মালীর ঐ পিটনিগুলা!
কি বলিস? ফের হপ্তা!
তৌবা–নাক খপতা!